“জন্মভূমির স্পর্শ, নতুন বাসভূমে”এই হৃদয়ছোঁয়া স্লোগানকে সামনে রেখে আয়োজিত এবারের উৎসব শুধু একটি সাংস্কৃতিক আয়োজন নয়, ছিল প্রবাস জীবনের গর্ব, ঐতিহ্য পুনর্খোঁজের এক মিলনমেলা। শেষ দিনের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন দুই ভাই, প্রীতম ও প্রতীক, যাঁদের প্রাণবন্ত পরিবেশনায় যেন হৃদয়ে বাজে শিকড়ের সুর। বাংলা গান, স্মৃতির ঝংকার আর আধুনিক সুরের ছোঁয়ায় তাঁরা তৈরি করে তোলেন এক রঙিন আবেশ, যা প্রবাসীদের মুগ্ধ করে রাখে।
মেলার আয়োজন শুরু থেকেই ছিল প্রবাসী বাঙালিদের পদচারণায় মুখর। মিশিগানের বিভিন্ন সিটি থেকে আগত বাংলাদেশি-আমেরিকানরা যোগ দেন এই উৎসবে। চোখে পড়ার মতো ছিল বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ মেলাকে করে তোলে আরও বেশি জীবন্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ।

অনুষ্ঠানের সূচনায় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব মিশিগান (বাম)-এর উপদেষ্টা এবং ওয়ারেন সিটির ক্রাইম কমিশনার সুমন কবির এবং বামের পাবলিসিটি ও ইনফরমেশন সেক্রেটারি তাহমিদ চৌধুরীর যৌথ সঞ্চালনায় শুরু হয় উৎসবের শেষ দিনের আনুষ্ঠানিকতা। বক্তব্য রাখেন যুক্তরাষ্ট্র সিনেট পদপ্রার্থী আব্দুল সৈয়দ, ওয়ারেন সিটির মেয়র লরি স্টোন (প্রোক্লেমেশনসহ), স্টেট সিনেটর ম্যালোরি ম্যাকমরো, স্টেট রিপ্রেজেন্টেটিভ টনিয়া মেয়ার্স ফিলিপস-এর পক্ষে প্রতিনিধি রুথ জনসন, মার্কিন কংগ্রেস সদস্য এলিসা স্লটকিন (প্রোক্লেমেশনসহ), মিশিগান ইমিগ্রান্ট অ্যান্ড রিফিউজি কাউন্সিল-এর আহমাদ আলকাবি ও ইয়ারা শাদ্দা, স্টেট সিনেটর (ডিস্ট্রিক্ট ১০) পদপ্রার্থী অ্যামান্ডা ট্রেপ্পা, অ্যাটর্নি জেনারেল পদপ্রার্থী এলি সাভিট, ইউএস কংগ্রেস পদপ্রার্থী ক্রিস্টিনা হাইনস, বাংলাদেশ সোসাইটি অফ ইউএসএ ইনক (নিউ ইয়র্ক)-এর বোর্ড অব ট্রাস্টিজ সদস্য জুনেদ চৌধুরী, সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম, সিটি অফ ট্রয়ের কাউন্সিলম্যান পদপ্রার্থী সাদেক রহমান সুমন, হ্যামট্রাম্যাকের মেয়র পদপ্রার্থী মুহিত মাহমুদ, সাবেক কাউন্সিলম্যান নাইম চৌধুরী, বামের ট্রাস্টি ও সাবেক সভাপতি মতিন চৌধুরী, সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আহাদ, বর্তমান সভাপতি জাবেদ চৌধুরী, ব্যবসায়ী গিয়াস তালুকদার (বেঙ্গল অটো), প্রাইম লেন্ডিং-এর সানি জায়গিরদার ও রসি মীর, এবং এস এন এস লোন-এর তুফায়েল আহমেদ।
ওয়ারেন সিটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কমিউনিটি-আয়োজিত এই উৎসবে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব মিশিগান (বাম)-কে তিনটি সম্মানজনক প্রোক্লেমেশন প্রদান করা হয়। যা প্রবাসে বাংলাদেশের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে।
শুধু গান বা বিনোদন নয়। মেলায় ছিল বাংলাদেশের এক ব্যাপক সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা। দেশীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক, বাচ্চাদের খেলনা, মুখরোচক খাবারের স্টল। সব মিলিয়ে যেন মেলা হয়ে উঠেছিল প্রবাসে বসে নিজ শিকড়কে নতুন করে ছুঁয়ে দেখার এক অনন্য উপলক্ষ।
চিরায়ত বাংলার গ্রামীণ আবহকে ধারণ করে সাজানো মেলা প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়িয়েছে বাঙালি পরিবার, হাসি মুখে শিশুরা, আর প্রজন্ম পার হয়ে আসা অভিবাসীরা। এ যেন এক অন্যরকম মিলনক্ষেত্র। ভাষা, সংস্কৃতি, গান আর আত্মপরিচয়ের এক উৎসব।
মেলার শেষ পর্বে আয়োজিত র্যাফেল ড্র এবং পুরস্কার বিতরণী আয়োজন দর্শকদের মাঝে সঞ্চার করে বাড়তি উচ্ছ্বাস। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে আয়োজক সংগঠন বাংলাদেশি আমেরিকান মুক্তিযোদ্ধা সংসদ (বামের) সভাপতি জাবেদ চৌধুরী মেলায় আগত সকল দর্শক-অতিথিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এবং ভবিষ্যতে সংগঠনের নানা কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। তাঁর কণ্ঠে প্রতিফলিত হয় প্রবাসে থেকেও স্বদেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার অঙ্গীকার। ফেস্টিভ্যালের এ সফল ও সুশৃঙ্খল আয়োজন প্রমাণ করে যে প্রবাসে থেকেও বাঙালি তাঁর শেকড় ভুলে যায় না। বরং প্রবাসজীবনের ব্যস্ততা ও দূরত্বের মাঝেও নিজ সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও দেশপ্রেমকে জিইয়ে রাখার এক অবিচল প্রয়াসই এই উৎসবের মূল প্রাণ।

এই বর্ণাঢ্য আয়োজনের পেছনে নিরলস পরিশ্রম, পরিকল্পনা এবং নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব মিশিগান (বাম)–এর বর্তমান নির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্দ।
নেতৃত্ব দিয়েছেন সংগঠনের সভাপতি জাবেদ চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে সহ-নেতৃত্বে ছিলেন নির্বাহী সহ-সভাপতি বিজিত ধর মনি, সহ-সভাপতি সাঈদ এম. রহমান শিমু, আলী আহমেদ ফারিস এবং লুৎফুর আর. শিলু।
প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় ছিলেন কার্যকরী সম্পাদক আজহার রহমান, যুগ্ম সম্পাদক তারেক জামান, কোষাধ্যক্ষ জসিম চৌধুরী, সহকারী কোষাধ্যক্ষ সাইফ ইসলাম, সাংগঠনিক ও অফিস সম্পাদক আবেদ মনসুর।
প্রচারণা ও যোগাযোগের দায়িত্বে ছিলেন প্রচার ও তথ্য সম্পাদক তাহমিদ চৌধুরী, সহকারী প্রচার ও তথ্য সম্পাদক মজহারুল আহমেদ। শিক্ষা ও সাহিত্য বিভাগে নেতৃত্ব দিয়েছেন মীর তানভীর; ক্রীড়া ও বিনোদন বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন লিটন সূত্রধর এবং সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ কার্যক্রম দেখভাল করেছেন মো. আহমেদ দীপু।
নির্বাহী কমিটিকে সহায়তা করেছেন কমিটির সদস্যগণ: মুস্তাক চৌধুরী, রাব্বানী তালুকদার, কেডি বাবলু, সায়েম চৌধুরী এবং মুকুল খান।
এই টিমের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই সফলভাবে সম্পন্ন হলো প্রবাসের অন্যতম বৃহৎ ও প্রভাবশালী কমিউনিটি উৎসব—বাংলাদেশি-আমেরিকান ফেস্টিভ্যাল ২০২৫। তাঁদের নিরবিচার সংগঠন, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমই প্রমাণ করে প্রবাসে থেকেও একজন বাঙালি তার জাতিসত্তা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে হৃদয়ে ধারণ করে কীভাবে গর্বের সঙ্গে এগিয়ে নিতে পারে।